সর্বশেষ সংবাদ
Home / ফিচার / ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ও নার্স পেশা নিয়ে কিছু কথা

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ও নার্স পেশা নিয়ে কিছু কথা

আব্দুল্লাহ আল মাছুম:

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল সারা বিশ্বের নার্সের অনুপ্রেরণা। আধুনিক নার্সিং সেবার প্রতিষ্ঠান।  তিনি একই সঙ্গে লেখিকা, সমাজ সংস্কারক এবং পরিসংখ্যানবিদ।

তিনি ১৮২০ সালের ১২ মে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল ধনী পরিবারে। ছোটবেলা কেটেছে ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি গ্রামের অসুস্থ ও দরিদ্র মানুষদের সেবা করতেন।তিনি মনে করতেন মানব সেবা মানেই স্রষ্টার সেবা।তিনি বিশ্বাস করতেন এটিই তার ঈশ্বরদত্ত কর্ম।

কিন্তু তখনকার সময়ে নার্সিংকে সম্মানের চোখে দেখা হতো না। মনে করা হতো নার্সিং হলো নিচু শ্রেনী ও চাকর শ্রেনীর কাজ। এমনি তাঁর মা-বাবাও চাননি তিনি নার্স হোক।

আর তিনি যে সময়টায় জন্মগ্রহন করেছিলো সেটা ছিল ভিক্টোরীয় যুগ । এ সময়ে নারীদের সম্পদের কোন অধিকার ছিল না। মেয়েদের ধনী ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়াটাই প্রধান কাজ ছিল মা-বাবার। ১৮৪৯ সাল, নাইটিঙ্গেলের যখন ১৬ বছর বয়স। তখন রিচার্ড মনকটন মিলনস নামের এক ধনী ছেলে তাকে বিয়ের প্রস্তাব করে । কিন্তু তিনি বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

অনেক বাধা পেরিয়ে নাইটিঙ্গেল ১৮৫০ সালে জার্মানির কাইসারওয়ার্থের প্রোটেস্ট্যান্ট ডিকোনেসেস ইনস্টিটিউশনে নার্সিং ছাত্রী হিসাবে ভর্তি হন। শিক্ষা সমাপ্ত করে ফিরে এসেই তিনি লন্ডনের ‘কেয়ার অব সিক জেন্টলওমেন ইনস্টিটিউটের’ তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন।

১৮৫৩ সালের অক্টোবর মাসে তুরস্কের নিয়ন্ত্রিত দারদানেলিস প্রণালী দিয়ে যুদ্ধ জাহাজ চলাচলের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তুরস্কের খ্রিষ্টানদের রক্ষার অজুহাতে অটোমান সাম্রাজ্যের তুর্কি এলাকায় রাশিয়া আক্রমণ চালালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সূচনা হয়।

রাশিয়ার সঙ্গে এই যুদ্ধ চলে তুরস্ক তথা উসমানিয় বা অটোমান সাম্রাজ্যের মিত্রশক্তি ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং সারডিনিয়ার। ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত এই ক্রিমিয়ার যুদ্ধ চলে।

১৮৫৪ সালের ২১ অক্টোবরের দিকে, নাইটিঙ্গেল যুদ্ধ সচিব সিডনি হারবার্টের কাছ থেকে একটি চিঠি পান, যাতে তাকে ক্রিমিয়ায় অসুস্থ ও আহত সৈন্যদের সেবা করার জন্য নার্সদের একটি দল গঠনের অনুরোধ করা হয়। নাইটিঙ্গেল তার ডাকে সাড়া দেন।

৩৪ জন নার্সের একটা দল নিয়ে নাইটিংগেল ১৮৫৪ সালের নভেম্বরের শুরুর দিকে স্কুটারির (বর্তমানে ইস্তাম্বুল-এ অবস্থিত Üsküdar) সেলিমিয়ে ব্যারাকে উপস্থিত হন। সেখানে পেীঁছে তার দল দেখতে পায় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অবহেলার জন্য সেখানকার স্থানীয় মেডিকেল টিম যুদ্ধাহতদের ভাল যত্ন নিতে পারছিল না।

ওষুধের ঘাটতি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা ছিল না, মলের উপরই আহত সৈনিকরা শুয়ে থাকতো। যুদ্ধে আহত হয়ে মারা যাওয়ার থেকে টাইফয়েড এবং কলেরা সংক্রামক রোগে বেশি সংখ্যক সৈন্য মারা যাচ্ছিল। রোগীদের খাবার তৈরির বিশেষায়িত ব্যবস্থা ছিল না।

তিনি দ্রুতই তাঁর দল নিয়ে হাসপাতাল পরিস্কার-পরিছন্ন করেন। বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যকর খাবার ও পরিচর্যা বাড়িয়ে দেন। নাইটিঙ্গেল নিজেই প্রতিটি সময় সৈন্যদের সেবা করায় ব্যয় করলেন। সন্ধ্যায় তিনি রোগীদের দেখাশোনা করার সময় হাতে বাতি নিয়ে যেতেন।

রাতে একাদিকবার রাউন্ড দিতেন। এসব কাজে মুগ্ধ হয়ে সৈন্যরা তাকে ডাকতেন “দ্য লেডি উইথ দ্য লাম্প” বলে। কেউ কাউ থাকে “দ্য এঞ্জেল অফ ক্রিমিয়া” বলে ডাকতো। তার কাজের ফলে হাসপাতালের মৃত্যুর হার দুই-তৃতীয়াংশ কমে যায়।

১৮৫৫ সালের ২৯ নভেম্বর ক্রিমিয়ায় সেবিকাদের প্রশিক্ষণের জন্য “নাইটিংগেল ফান্ড” গঠন করা হয়। সেখানে প্রচুর সাহায্য আসতে থাকে। ১৮৬০ সালে, তিনি সেন্ট থমাস হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য “নাইটিংগেল ফান্ড” থেকে অর্থ সরবরাহ করেন এবং নার্সদের জন্য নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

নাইটিঙ্গেল জনসাধারণের প্রশংসার পাত্রে পরিণত হন।তাঁর নামে নাট্যকবিতা, গান এবং নাটক লেখা হয়। তরুণীরা তার মতো হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করত। এমনকি ধনী উচ্চ শ্রেণীর মহিলারাও প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হতে শুরু করে। নাইটিঙ্গেলের কল্যাণে, নার্সিং আর উচ্চ শ্রেণীদের দ্বারা নিন্দিত হয় না; বস্তুতপক্ষে, এটি একটি সম্মানীয় পেশা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল।

স্কুটারিতে(বর্তমানে ইস্তাম্বুল-এ অবস্থিত Üsküdar) থাকাকালীন, ৩৮ বছর বয়সেই নাইটিঙ্গেল “ক্রিমিয়ান জ্বর” আক্রান্ত হন । এ জ্বর থেকে কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হননি। জীবনের বাকিটা শয্যাশায়ী অবস্থায় থাকেন। কিন্তু তিনি এ অবস্থায় থেকেও তার কাজ চালিয়ে যান।

১৮৫৯ সালে ‘নোটস অন নার্সিং’ নামে তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয়। বইটি নার্সিং পেশার একটি বিপ্লবী রচনা। এই বইটিতে, নাইটিঙ্গেল কেবল নার্সিংয়ের সংজ্ঞা দেননি বরং একজন দক্ষ ও সহানুভূতিশীল নার্স হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী, দক্ষতা এবং জ্ঞানও তুলে ধরেছেন।

তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারটি হলো ‘রয়েল রেড ক্রস’। ১৮৮৩ সালে রানী ভিক্টোরিয়া তাঁকে এ পদক প্রদান করেন। এ ছাড়া প্রথম নারী হিসেবে অর্জন করেন ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব।

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে নার্সিং-এর জননী বলা হয়। তার আত্মত্যাগ ও চিন্তা-চেতনার জন্য বিশ্বের অন্য পেশা থেকে এ পেশা ব্যতিক্রমধর্মী সেবামূলক পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়।

বহু মনীষী ফ্লোরেন্সকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখন যারা এ পেশায় নতুন আসেন তারা ‘নাইটিঙ্গেল প্লেজ’ নামে একটি শপথ গ্রহণ করে তার প্রতি সম্মান জানান। তার সম্মানেই ১৯৭৪ সাল থেকে তার জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’।

১৯১০ সালে, আগস্ট মাসের ১৩ তারিখ শনিবার ২ টার দিকে লন্ডনে তাঁর নিজ বাড়িতে মারা যান।

About admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

x

Check Also

বাঁশের তৈরি পণ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন পাটুনিরা 

রনজিত রায় – নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর প্রতিনিধি:: দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার তর্পন ঘাট (গোলাবাড়ি ...