সর্বশেষ সংবাদ
Home / লাইফস্টাইল / চায়ের শহরে চা জাদুঘর

চায়ের শহরে চা জাদুঘর

ধুলো-ধোঁয়ার শহর ছেড়ে স্বস্তির বাতাস নিতে চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল অনেকদিনের। ব্যস্ত দিনের ফাঁকে কখনো সময় মেলে তো সঙ্গী মেলে না, আবার কখনো সঙ্গী মেলে তো সময় মেলে না। এরই মধ্যে ব্যাটে-বলে মিলে যাওয়ায় স্থির হলো একদিনের জন্য শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের দিনক্ষণ।

শেষ পর্যন্ত অন্য ভ্রমণসংগীদের ফোন এ ঘুম থেকে উঠতেই হলো। ঘুম থেকে উঠেই ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। চার চাকার বহন করে আমরা ছুটে চললাম শ্রীমঙ্গল পানে। আমার সঙ্গে ভ্রমণসঙ্গী হিসাবে আছে সৃজন, অনিক, অর্চি, কৃপা ও অর্পা। সকালবেলা তাই সবাই গাড়িতে উঠেই ঝিমুতে লাগল। সূর্য দেবকে সঙ্গী করে আমরা এগিয়ে চলছি মহাসড়ক পেরিয়ে।

সূর্য দেবের আভায় উষ্ণতা ছোঁয়ায় অন্য রকম লাগছিল। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা পৌঁছলাম শ্রীমঙ্গলে। আমাদের চার চাকার বাহন ছুটে চলছে দু’পাশের দুটি পাতার একটি কুঁড়ি আমাদের স্বাগতম জানাচ্ছিল।

আমরা এসে দাঁড়ালাম চা জাদুঘরের প্রবেশদ্বারে। জনপ্রতি ২০ টাকা করে টিকিট কিনে এগিয়ে চললাম। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, সঙ্গে পাখিদের কিচিরমিচির বেশ ভালোই লাগছিল। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চললাম। প্রথম কক্ষে আমরা প্রবেশ করলাম। প্রথমটিতেই রয়েছে চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহার করা সেই চেয়ার-টেবিল।

শূন্য চেয়ার-টেবিলের পেছনে টাঙানো সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা জাতির পিতার আপাদমস্তক প্রতিকৃতি। কক্ষটিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর চা পান করার ছবিসহ আরও বেশকিছু স্থিরচিত্র। বলে রাখা ভালো, ১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসাবে দেশের চা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন।

বোর্ড চেয়ারম্যান থাকাকালীন চায়ের রাজধানীখ্যাত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল নন্দরানী চা-বাগান পরিদর্শনে আসেন বঙ্গবন্ধু। মিটিং করেন বাগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সেই মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু যে চেয়ারে বসেছিলেন, যে টেবিলটি তার সামনে রাখা ছিল, সেগুলো এখন দেশীয় চা শিল্পের ইতিহাসের অংশ হয়ে স্থান নিয়েছে শ্রীমঙ্গলের ‘টি রিসোর্ট অ্যান্ড মিউজিয়ামে’।

পাশের কক্ষেই দেখতে পেলাম চা গাছ ব্যবহার করে তৈরি করা আসবাবপত্রের। চা জাদুঘরের এ কক্ষটিতে আরও দেখতে পেলাম লালচান্দ চা-বাগান থেকে সংগৃহীত পুরোনো আমলের চা শুকানো যন্ত্রের অংশবিশেষ। কোদালা, বারোমাসিয়া ও কর্ণফুলী চা-বাগান থেকে সংগৃহীত চা-বাগানের আগাছা পরিষ্কার করার কাঁটা কোদাল, রিং কোদাল এ কক্ষেই সংরক্ষিত।

ব্রিটিশ আমলে চায়ের চারা রোপণের গর্ত ও চা গাছ উপড়ানোর জন্য ব্যবহৃ ত প্লান্টিং হো, কোদালা চা-বাগানের শ্রমিক সুদর্শনের সংগৃহীত চা গাছ ছাঁটাইয়ের কাজে ব্যবহৃ ত কমল দা, ব্রিটিশ আমলে চা গাছ ছাঁটাইয়ের কাজে ব্যবহৃ ত পরুনিং দা, মাটি কোপানো ও চা গাছের শিকড় কাটার জন্য ব্যবহৃ ত রিং কোদাল।

১৯৬০ সালে শ্রমিকদের নাম-পদবি ও মজুরি হারসহ বিভিন্ন তথ্যসমৃদ্ধ শাহবাজপুর চা-বাগানের ব্যবহৃ ত সার্ভিস বুক এ কক্ষটিতে সংগ্রহে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে লোহার পাপস, চা-শ্রমিকদের জন্য ব্যবহৃ ত বিশেষ রূপা ও তামার মুদ্রা। ব্রিটিশদের গুনতির কাজে ব্যবহৃত হাড়ের ছড়ি, লাঠি, শ্রমিকদের পূজা-অর্চনায় ব্যবহৃ ত কষ্টিপাথরের প্লেট, ব্যবস্থাপক বাংলোয় ব্যবহৃ ত প্রাচীন বেতারযন্ত্র, কলের গান রেকর্ডসহ চা পাতা সংগ্রহে চয়ন যন্ত্র ও বাগানের নারী শ্রমিকদের ব্যবহৃ ত রুপার গহনা সংগৃহীত হয়েছে কক্ষটিতে।

তৃতীয় কক্ষে রয়েছে চা শিল্পে ব্যবহৃ ত ব্রিটিশ আমলের টারবাইন পাম্প, লিফট পাম্প, হস্তচালিত নলক‚প, বাগানের সীমানা ও জমি পরিমাপের জরিপ শিকল, সিরামিকের পানির ফিল্টার, সিরামিক জার, উনিশ শতকের প্রাচীন বৈদ্যুতিক পাখা, পুরোনো রেডিও টেলিফোন সেট, পরুনিং দা, টাইপ রাইটার, প্রাচীন পিএইচ মিটার ও চা প্রক্রিয়াকরণ সামগ্রী।

আছে তীর-ধনুক, দেওয়ালঘড়িসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাউয়াছড়া বনে বিধ্বস্ত হওয়া একটি যুদ্ধবিমানের অংশবিশেষও। দীর্ঘদিন মাটির নিচে থেকে কাঠ-পাথরে রূপান্তরিত চার খণ্ড জীবাশ্ম ঠাঁই করে নিয়েছে কাচের ফ্রেমে। রয়েছে নেপচুন চা-বাগান থেকে সংগৃহীত কেরোসিনের কুপি দিয়ে চালিত মাঝারি ফ্রিজ, মাথিউড়া চা-বাগান থেকে পাওয়া হাতে ঘোরানো টেলিফোন সেট এবং বাগানের হিসাবরক্ষকদের ব্যবহৃ ত ক্যাশ বাক্স।

অবিভক্ত ভারতের এ অঞ্চলে চা-শিল্পের যাত্রা শুরু উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। ১৮২৮ সালে চট্টগ্রামের কোদালায় চা-বাগান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে যে স্থানটিতে চট্টগ্রাম ক্লাব, ঠিক সেখানেই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চা গাছের চারা রোপণ করা হয় ১৮৪০ সালে। তবে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা-শিল্পের যাত্রা শুরু সিলেটে।

১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে প্রতিষ্ঠিত হয় মালনিছড়া চা-বাগান। সেখান থেকে দেশীয় চা শিল্পের গোড়াপত্তন। এর ১৭০ বছর পরের ইতিহাস একেবারেই ভিন্ন। বর্তমানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয়, গ্রামীণ দারিদ্র্যদূরীকরণসহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে চা-শিল্প। এ শিল্পের বহুমুখী বিকাশও ঘটছে উত্তরোত্তর।

ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলছে তার গতিতে, এবার আমাদের বিদায় নেওয়ার পালা। কীভাবে একটি ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম টের পেলাম না। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য অক্ষিপটে ভেসে উঠেছিল।

About admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

x

Check Also

শিশুকে শাসনের ব্যাপারে জেনে রাখুন কিছু কৌশল

সন্তান লালনপালন সহজ কোনো কাজ নয়। শিশুদের নতুন নতুন জিনিস শেখানোর সঙ্গে ...