সর্বশেষ সংবাদ
Home / ধর্ম / ইতেকাফ: আল্লাহকে পাওয়ার সাধনা

ইতেকাফ: আল্লাহকে পাওয়ার সাধনা

পুণ্যময় রমজান মুমিনজীবনে এক অনন্য অধ্যায়। পার্থিব বিষয়বালীর ক্ষেত্রে মানুষের জীবনে কিছু আনন্দ ও খুশির মুহূর্ত রয়েছে। যেমন- ছাত্রের জন্য ফলাফল ঘোষণার সময়, পিতা-মাতার জন্য সন্তান লাভের সময় প্রভৃতি। অনুরূপ মুমিন বান্দার জন্য ইবাদাতের ফসল চাষ করে পরকালীন পুণ্য অর্জনের রয়েছে ঊর্বর মওসুম, উৎকৃষ্ট সময়। আর তা হচ্ছে রমজান মাস। এই মাসে অবতীর্ণ করা হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব মহাগ্রন্থ কোরআন মাজিদ।

রমজান মাসের প্রধান ইবাদাত সাওম বা রোজা। রোজার প্রতিদান আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে দেয়ার সুসংবাদ হাদিসে কুদসিতে রয়েছে। এই মাসেই রয়েছে হাজার মাস থেকেও উত্তম রাত, লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। হাদিসের বর্ণনানুযায়ী লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতসমূহের কোনো একদিন হয়ে থাকে। আর এই দশকটিই আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বিশেষ নিয়মে মসজিদে অবস্থান করাই হচ্ছে ইতেকাফ। অভিধানে ইতেকাফ অর্থ- অবস্থান করা, আবদ্ধ করা। বান্দা নিজেকে পার্থিব বিষয়াবলী থেকে আবদ্ধ করে প্রভুর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য মহান মাওলার ঘর মসজিদে অবস্থান করে বলেই ইতেকাফ বলা হয়।

আল্লাহ বলেন, ‘আমি বিধান জারি করলাম ইবরাহিম আ. ও ইসমাইল আ. এর প্রতি- তোমরা পবিত্র রাখো আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু সেজদাকারীর জন্য।’ (আল কুরআন – ২ : ১২৫) রাসুল সা. কিছু কিছু আমল মাঝেমধ্যে ছাড়তেন। ইতেকাফ হচ্ছে রাসুল সা. এর এরূপ একটি আমল, যা হিজরতের পর কখনও ছাড়েননি। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাসুল সা. মদিনায় হিজরতের পর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি রমজানের শেষ দশক ইতেকাফ করেছেন এবং তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীরা ইতেকাফ করেছেন। (বুখারি, মুসলিম)

ইতেকাফের সর্বোত্তম স্থান মসজিদে হারাম, মর্যাদার অবস্থানে দ্বিতীয় স্থান হচ্ছে মসজিদে নববী সা. এবং তৃতীয় বায়তুল মোকাদ্দাস। অতঃপর জামে মসজিদসমূহ, সবশেষে ওইসব মসজিদ যেগুলোতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা হয়। অর্থাৎ পাঞ্জেগানা মসজিদ। ইতেকাফ তিন প্রকার। যথা, ওয়াজিব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়াহ ও মুস্তাহাব। বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য বা এমনিতেই রমজানের শেষ দশক ইতেকাফের মান্নত করলে তা আদায় করা হচ্ছে ওয়াজিব ইতেকাফ। প্রতি জামে মসজিদে রমজানের শেষ দশক ইতেকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়াহ। কমপক্ষে গ্রাম বা পাড়া-মহল্লার একজন পুরুষ আদায় করলে মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। অন্যথায় সবাই এই ইবাদাত ত্যাগকারীর পাপকারী বলে গণ্য হয়ে যান। এই দুই প্রকার ইতেকাফ ছাড়া যেকোনো সময় মসজিদে ইতেকাফের নিয়তে অবস্থান করা হচ্ছে মুস্তাহাব। আমরা সব সময় মসজিদে এই নিয়তে প্রবেশ করবো। এতে অতিরিক্ত পুণ্য লাভ হবে।

ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতেকাফের জন্য রোজাদার হওয়া শর্ত। এই দুই প্রকার ইতেকাফের জন্য ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। ইতেকাফকারীকে স্মরণ রাখতে হবে, তিনি পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানিত ও সর্বোত্তম স্থান মসজিদে বছরের শ্রেষ্ঠ সময়ে অবস্থান করছেন। মূল্যবান সময় ও স্থানে ইবাদত সম্পাদন করলে পরিমাণ-ওজনে সওয়াব অধিক হয় তদ্রূপ বিপরীত ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ পাপকাজে গোনাহও বেশি হয়। সুতরাং ইতেকাফকারী সবসময় নিজেকে ইবাদতে ব্যস্ত রাখবেন। সবধরনের গোনাহর কাজ এবং অনর্থক গল্পগুজব থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকবেন। মসজিদের আদব পরিপন্থী যাবতীয় কাজ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি ইতেকাফ বিশুদ্ধ হওয়ার আবশ্যকীয় কিছু মাসয়ালা অনুসরণ করবেন। যথা- ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ উদিত হওয়ার সংবাদ শোনার পূর্ব পর্যন্ত রোজাসহ মসজিদে অবস্থান করতে হবে।

কারও রোজা ভেঙে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে বা সাওমের সক্ষমতা না থাকলে অথবা রোজা অবস্থায় নিষিদ্ধ এমন কোনো কাজ ইতেকাফকারীর পক্ষ থেকে সংঘটিত হলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। ইতেকাফকারী এই সময়টুকুর মধ্যে প্রাকৃতিক প্রয়োজন, ওজু ও ফরজ গোসলের প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতে পারবেন না। এ প্রয়োজনগুলোর কোনো একটির জন্য বের হয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মুহূর্তকাল সময়ও বাইরে থাকতে পারবেন না। এমনকি কেউ ইতেকাফের কথা ভুলে গিয়ে বাইরে সামান্যতম সময় অতিবাহিত করলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, ইতেকাফে প্রাকৃতিক প্রয়োজন, ওজু ও ফরজ গোসল, পাঞ্জেগানা মসজিদে ইতেকাফ করলে জুমার নামাজের জন্য জামে মসজিদে যাতায়াত এবং মসজিদে খাবার এনে দেয়ার মতো কেউ না থাকলে খাদ্যগ্রহণের জন্য যাতায়াতের অনুমতি (অবশ্য তা একদম প্রয়োজন অনুযায়ী ও চুপচাপ হতে হবে) ব্যতীত ব্যক্তিগত, ধর্মীয় বা জনসেবামূলক কোনো কাজের জন্য বাইরে বের হওয়ার অনুমতি নেই। তাই অভ্যাসগত সাধারণ গোসল, কাপড় কাঁচা, হাত-মুখ বা অন্য কিছু ধোয়া-মুছা/ পরিষ্কার করা বা ধূমপান, গল্পগুজব প্রভৃতির জন্য বাইরে বের হওয়া মাত্রই ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যায়। ইতেকাফকারী অনুমতি ছাড়া কারও কোনো কিছুতে হাত দেবেন না, ব্যবহার করবেন বা। মসজিদ বা মুসল্লির ক্ষতি হয় এরূপ সবকিছু থেকে সর্বদা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবেন।

ইতেকাফ সঠিক ও পুণ্যময় হওয়ার জন্য ইতেকাফকারীকে বিষয়গুলোর প্রতি অবশ্যই যত্নবান হতে হবে। মহিলারা নিজ ঘরের নির্জন স্থানে ইতেকাফ করবেন। ইবাদাত, পানাহারসহ সব কাজে এস্থানেই নিজেকে সব সময় আবদ্ধ রাখবেন। অনর্থক ও পার্থিব কথাবার্তা, কাজকর্ম থেকে বিরত থাকবেন। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ও ওজুর প্রয়োজন ছাড়া নির্দিষ্ট স্থান হতে বের হবেন না। ইতেকাফের ফজিলত সম্পর্কে রাসুল সা. বলেন, রমজানর শেষ দশক ইতেকাফের সওয়াব হচ্ছে, দুটি হজ ও উমরাহর সমপরিমাণ। (বায়হাকি) ইতেকাফ মহান প্রভুর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম পন্থা। বান্দা শুধু পরকালীন পুণ্য লাভের উদ্দেশ্য পার্থিব সব প্রয়োজন পেছনে ফেলে দশটি দিন আপন প্রভুর ঘর মসজিদে তারই বন্দেগিতে নিবিষ্ট থাকে। কেবলই দরবারে এলাহিতে আরাধনা, প্রার্থনা করে। তাসবিহ-তাহলিল, তেলাওয়াত, জিকির, সালাত তথা ইবাদাত-বন্দেগিতে নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখে। প্রাণভরে সেজদা করে, নীরবে-নীভৃতে অশ্রু ঝরায়, কাকুতি-মিনতি করে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল চাওয়া-পাওয়া মনিবের হাতে সোপর্দ করে। পেছনের জীবনের পাপের জন্য ব্যথিত হৃদয়ে অনুতপ্ত হয়। লজ্জিত হয়ে প্রতিশ্রুতি দেয় ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না করার। প্রকৃত প্রেমাস্পদের ভালোবাসা পেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

এককথায়, নিজেকে আপাদমস্তক সপে দেয় রাব্বে কারিমের হাতে। বুঝাতে চায়- প্রভু, আমি তোমার অনুগত বান্দা। তুমি আমাকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছো, আমি আমার সামর্থে্যর সবটুকুই তোমার জন্য নিবেদন করছি। আমার সালাত, ইবাদাত, বেঁচে থাকা, ইন্তেকাল সবই শুধুমাত্র তোমার জন্য। আমি তোমাকে পেতে, তোমার ভালোবাসা পেতে, সন্তুষ্টি পেতে–তোমার ঘরে ছুটে এসেছি, তোমার দুয়ারে পড়ে রয়েছি। আমাকে বঞ্চিত করো না; কবুল করে নাও, তোমার প্রিয় করে নাও।

দুনিয়ার কোনো কৃপণ প্রকৃতির লোকের কাছ থেকে কেউ দুয়েক বার বিফল হয়ে ফিরে এসে যখন আবার যায়, মিনতি করতে থাকে, শেষ পর্যন্ত কিছুটাও হলেও সফল হয়। অফুরন্ত দয়ার সাগর, অকল্পনীয় ভালোবাসার মহান অধিপতির পক্ষে কী করে সম্ভব, তাঁর বান্দাকে রিক্তহস্তে ফিরিয়ে দেয়া, তাঁর প্রেমসাগর আর ভালবাসার মোহনায় অবগাহন না করিয়ে তাড়িয়ে দেয়া? আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন- ‘ ইতেকাফের মাহাত্ম্য হলো আল্লাহর সাথে রুহ ও অন্তরের সম্পর্ক স্থাপন করা। ইতেকাফকারীর দৃষ্টান্ত ওই ব্যক্তির মতো- যে কারো দরবারে হাজির হয়ে এ কথা বলে যে, আমার দরখাস্ত কবুল না করা পর্যন্ত আমি ফিরবো না।’

সুতরাং বলা যায়, ইতেকাফ প্রভুর ভালোবাসা এবং সান্নিধ্য লাভের সোপান। পবিত্র জীবন গঠনের, সর্বোপরি- যাবতীয় পাপকাজ থেকে মুক্ত থেকে একনিষ্ঠভাবে খোদাভীরু-মুত্তাকি হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার ব্যতিক্রমী অনুশীলন হচ্ছে ইতেকাফ। আসুন, শূন্য থলে পুণ্যে ভরার বসন্ত উৎসবে ইতেকাফের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করি। অযত্ন-অবহেলা, অনর্থক আর গোনাহ’র কাজে জীবনে কত সময় নষ্ট করেছি তার তো কোনো ইয়ত্তা নেই। দশটি দিন মহান রাব্বে কারিমের কাছে মঞ্জুর হয়ে গেলে তা পূর্বের সব পাপকে পুণ্যে পরিবর্তন করে দিতে পারে। জান্নাতের পথ ধরে হয়ে যেতে পারে আগামীর পথচলা। আল্লাহর রঙ-এ রঙিন হয়ে যেতে পারে জীবন। রাব্বে কারিম, আমাদের তাওফিক দিন মহিমান্বিত ইতেকাফসহ সব পুণ্য কাজের, ইবাদাতের। আমিন।

লেখক: আলেম, ধর্মীয় নিবন্ধকার

About admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

x

Check Also

জু’মআর নামাযঃ  ফযিলত ও গুরুত্ব

মাওলানা সাইফুল ইসলামশি,ক্ষক: মাদরাসাতুল হিকমাহ,ঢাকা: ২৪ ফিট, রসূলবাগ, কদমতলী, ঢাকা   একজন ব্যক্তি ঈমান আনার ...