সর্বশেষ সংবাদ
Home / সারাদেশ / খুলনা বিভাগ / সাতক্ষীরায় সাবেক ওসি ও এসআইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

সাতক্ষীরায় সাবেক ওসি ও এসআইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

 

তালা (সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা:

আট বছর আগে হোমিও চিকিৎসক ডা. মোখলেছুর রহমান জনিকে ধরে এনে লকআপে তিন দিন আটক রাখার পর নিখোঁজ হয়।

সেই ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে সদর থানার সাবেক ওসি এমদাদুল হক শেখ ও উপ-পরিদর্শক হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

একইসঙ্গে জামিন আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে সদর থানার সাবেক ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লার।

রোববার (২৬ মে) সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম এসএম আশিকুর রহমান এক জনাকীর্ণ আদালতে এ আদেশ দন। একইসঙ্গে এমদাদ শেখ ও হিমেলের আইনজীবীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আসামিরা হলেন পিরোজপুর জলা সদরর পিরোজপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ শেখের ছেলে সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক ওসি এমদাদুল হক শেখ ও নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার পাংখাচর গ্রামের সাঈদুর রহমানের ছেলে ও সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক উপ-পরিদর্শক হিমেল হোসেন।

জামিনে মুক্তি পাওয়া আসামি হলেন গোপালগঞ্জ জেলা সদরের করপাড়া গ্রামের আব্দুল কাদের মোল্লার ছেলে ও সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লা।

জানা যায়, ২০১৬ সালর ৪ আগস্ট রাত সাড় ৯টার দিকে অসুস্থ বাবার জন্য বাইসাইকেলে ঔষধ কিনতে যেয়ে সাতক্ষীরা শহরের লাবনী সিনেমা হলের সামনে ফটোস্টাটের দোকান থেকে সদর থানার উপ-পরিদর্শক হিমেল হোসেন শহরের পার কুখরালী শেখ আব্দুর রাশেদের ছেলে হোমিও চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান জনিকে (২৭) থানায় ধরে নিয়ে যান।

৫, ৬ ও ৭ আগস্ট স্ত্রী জেসমিন নাহার রেশমা তার শ্বশুর আব্দুর রাশেদ, মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ ও স্বজনদের নিয়ে থানা লক আপ থেকে খাবার দিয়েছেন, তার সঙ্গে কথা বলেছেন। ওসি এমদাদুল হক শেখ ও উপ-পরিদর্শক হিমেলের সঙ্গে কথা বললে জনির আল্লার দলে নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানানো হয়।

স্বামীর মুক্তির বিনিময়ে তৎকালীন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ এমদাদ হোসেন ও উপ-পরিদর্শক হিমেল ডা. জনির স্ত্রী রেশমার কাছে দাবি করেন মোটা অংকের টাকা। টাকা না দিলে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। ৮ আগস্ট থানায় গেলে জনিকে পাওয়া যায়নি।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহম্মেদ, পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন (তালা উপজেলার পাটকেলঘাটায় ১২০ ভরি সোনা আত্মসাতের অভিযোগে গত ২০২১ সাল চাকরিচ্যুত), সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি।

ওই বছরর ২৬ ডিসেম্বর পুলিশ সাধারণ ডায়েরি না নেওয়ায় সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন জেসমিন নাহার রেশমা। অবশেষে ২০১৭ সালর ২ মার্চ হাইকার্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন জেসমিন নাহার রেশমা।

মামলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আটজনকে বিবাদী করা হয়। পরবর্তীতে আদালত মোখলেছুরকে ওই বছর ১২ এপ্রিলের মধ্যে সাতক্ষীরার বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করানোর নির্দেশের পাশাপাশি ৯ মে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ঢাকা লিগ্যাল সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এএসএম জাভিদ হাসানকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

তদন্তকালে সাতক্ষীরা সদর থানার তৎকালীন ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লা নিখোঁজ ডা. মোখলেছুর রহমান জনি আল্লার দল নামে একটি জঙ্গী সংগঠন করতেন বলে লিখিতভাবে উল্লেখ করেন। প্রতিবেদন রিটকারীর বিপক্ষে যায়।

পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হাবিবুল্লাহ মাহমুদ হাইকার্টে বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে থানা লকআপ থেকে ডা. জনির নিখোঁজ হওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।

প্রতিবেদনে তৎকালীন পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন, ওসি শেখ এমদাদ হোসেন, ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপ-পরিদর্শক হিমেল হোসেন হোমিও চিকিৎসক ডা. মাখলেছুর রহমানকে লাবনী মোড় থেকে তুলে আনা, থানা লকআপে নির্যাতন ও সেখান থেকে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় জড়িত বলে উল্লেখ করেন।

জনিকে পরবর্তীতে এক আদেশে ওই বছরের ৩ অক্টোবরের মধ্যে এ সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো ইনভেসটিগেশন) নির্দেশ দেওয়া হয়। পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে ডা. জনিকে থানায় এনে আটক রাখার সত্যতা মেলেনি বলে উল্লেখ করা হয়।

২০১৮ সালর ২৪ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে হাইকার্ট ডা. জনি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি নিয়ে তার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য ওসি এমদাদুল হক শেখ, ফিরোজ হোসেন ও উপ-পরিদর্শক হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা গ্রহণ ও একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা যেতে পারে বলে এক আদেশে উল্লেখ করেন।

পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গার আইন সহায়তা চেয়ে না পেয়ে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামালের সহায়তায় নিখোঁজ জনির বাবা শেখ আব্দুর রাশেদ ২০২১ সালর ১৭ আগস্ট সাতক্ষীরা মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলায় আসামি সদর থানার সাবেক ওসি শেখ এমদাদ হোসেন, ফিরোজ হোসেন ও উপ-পরিদর্শক হিমেলের বিরুদ্ধে জনিকে অপহরণ করে হত্যার পর লাশ গুমের অভিযোগ আনা হয়। মামলার নথিতে হাইকার্টে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের আদেশের জাবেদা নকল, রিট পিটিশন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন ও পিবিআই প্রতিবেদনের ছায়ালিপি জমা দেওয়া হয়।

মামলা তদন্তে গোয়েন্দা, অপরাধ ও তদন্ত শাখার কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক হারুণ অর রশীদ আসামিদের বিরুদ্ধে বাদীর আনিত অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। প্রতিবেদনে ডা. জনির শাশুড়ি কলারোয়া উপজেলার লাঙ্গলঝাড়া গ্রামের মনোয়ারা খাতুনের জমি তৎকালীন লাঙ্গলঝাড়া ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন (বর্তমান প্রয়াত) কৌশলে ইউনিয়ন পরিষদের নামে লিখে নেওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদবিরকারক হিসেবে ডা. মোখলেছুর রহমান জনিকে শায়েস্তা করার জন্য কলারোয়া থানা থেকে হঠাৎ বদলি হয়ে আসা উপ-পরিদর্শক হিমেলের মাধ্যমে শহরের লাবণী মোড় থেকে তুলে আনা হয় মর্মে উল্লেখ করা হয়।

পরবতীতে এমদাদ হোসেন ও হিমেলের পরিকল্পনায় ডা. মোখলেছুর রহমান থানা লকআপ থেকে নিখোঁজ হন। নিখোঁজের ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করতে গেলে তা গ্রহণ করেননি তৎকালীন ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লা। প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী চতুর্থ ধার্য দিন গত ২৯ জানুয়ারি আদালত তিন আসামির বিরুদ্ধে সমন জারির নির্দেশ দেন।

এর আগ ২০১৮ সাল উপ-পরিদর্শক হিমেলের বিরুদ্ধে ও সাবেক ওসি এমদাদ শেখ ও ফিরাজ হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে যথাক্রমে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় এমদাদ হোসেন ও ফিরোজ হোসেন মোল্লাকে চাকরি থেকে বিদায় দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হয়।

ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে শেখ এমদাদ হোসেন উচ্চ আদালতে গেলে পরবর্তীতে তাকে পাবনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখন তিনি অবসরে।

এ ব্যাপারে নিখোঁজ ভুক্তভোগী ডা. মোখলেছুর রহমানের বাবা শেখ আব্দুর রাশেদ জানান, এমদাদ হোসেন ও হিমেল আদালতে হাজিরা দিয়েও কাঠগড়ায় না উঠে পালিয়ে যাওয়ায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছে।

ফিরোজ হোসেন মোল্লার জামিন না হলে খুশি হতেন তিনি। তবে তার ছেলে জীবিত বা মৃত অবস্থায় উদ্ধার করতে গেলে আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

তাই কোন আইনে আসামিদের সিআর মামলা থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় জিআর মামলায় বা অন্য কোন প্রক্রিয়ায় রিমান্ডে নেওয়া যায় তার জন্য আইনি প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবেন তিনি।

সাতক্ষীরা জজকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা আইনজীবী মোসলেমউদ্দিন ও আইনজীবী ফরহাদ হোসেন বলেন, থানা লকআপে তিনদিন আটক রাখার পর ডা. মোখলছুর রহমান জনি নিখোঁজ হয়ে গেল। ভিকটিম উদ্ধারে আসামিদের রিমান্ড নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

তাই এ সংক্রান্ত আইনি ব্যাখ্যা চেয়ে তারা ঢাকার জ্যেষ্ঠ আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। একজন বাবা ও মা তাদের সন্তানকে, স্ত্রী তার স্বামীকে ও সন্তান তার বাবাকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় দেখতে পাবে না এটা হতে পারে না।

এমদাদ শেখ ও হিমেলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পাশাপাশি তাদের পক্ষের আইনজীবী নজরুল ইসলাম জীবনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফিরোজ হোসেন মোল্লা ৫ হাজার টাকা বন্ডে জামিন পেয়েছেন। আগামী ২৭ জুন পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা আদালতের পুলিশ পরিদর্শক মেহেদী হাসান রোববার আদালতে এমদাদ শেখ ও হিমেলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও ফিরোজ হোসেন মোল্লার জামিন মঞ্জুর হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

About admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

x

Check Also

বেনাপোল স্থলবন্দরে রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে  ১৫০ কোটি টাকা

  আনোয়ার হোসেন, নিজস্ব প্রতিনিধি,যশোরঃ ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় বেনাপোল স্থল বন্দর ...