সদরুল আইনঃ
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বুধবার জামাত শিবির নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপণ জারি করবে সরকার।এই প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে ৭১’র নরঘাতক পাক দোসরদের রাজনৈতিক অধিকার চিরতরে বিলুপ্তি ঘটবে।গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায়, ইতিহাসের অমর পাতায় সূচিত হবে নব ইতিহাস।লাখো শহিদের আত্মত্যাগ গৌরাম্বিত হবে।তাদের স্বপ্ন স্পর্শ করবে ইতিহাসের বেলাভূমি।
এদিক সোমবারের বৈঠকে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধে ১৪ দলের নেতারা একমত হয়েছেন জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এখন এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে সরকার। আইনগত দিক সঠিকভাবে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, যাতে কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে তারা আর কোনো সুযোগ না পায়।
মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত যৌথসভায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য অনেক দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধা ও নাগরিক সমাজ। তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সোমবার (২৯ জুলাই) ১৪ দলের সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এখন এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আইনগত দিক সঠিকভাবে দেখে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে, যাতে কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে এ বাংলাদেশে তারা আর কোনো সুযোগ না পায়।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে সবাই নিরীহ। তাহলে কারা নারকীয় ধংসযজ্ঞ চালিয়েছে? কারা নারকীয় বর্বরতা চালিয়েছে? সারা দেশ দেখেছে কী করেছেন আপনারা।
‘এ ঘটনাপ্রবাহে আমরা আক্রান্ত, আক্রমণকারী নই। এখন আক্রান্তদের অপবাদ দেয়া হচ্ছে। নিরস্ত্র ব্যক্তিরা সশস্ত্রদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন’, যোগ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
এ সময় গুজবের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান কাদের বলেন, যারা গুজব ছড়ায় তাদের তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিন।
‘গ্রেফতারের সময় নিরপরাধ মানুষকে কোনো অবস্থাতেই চার্জ করা যাবে না। গ্রেফতারের সংখ্যা বাড়াতে গিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে কেউ যাতে নিরপরাধ কাউকে হয়রানি না করে’, যোগ করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মান্ধ যে কোনও রাজনৈতিক সংগঠন করা নিষিদ্ধ ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে এই অরণ্য বিধান সংযোজন করেছিলেন।
কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্টের পর বাংলাদেশে আবার ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের আস্ফালন শুরু হয়। স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে পাশে টেনে নেন জিয়াউর রহমান। সেই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম বাংলাদেশে আসে। জামায়াত আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে একাধিক জামায়াতের শীর্ষ নেতা দণ্ডিত হন এবং সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্ত হন। এরপর থেকেই জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিভিন্ন মহলের জোরেশোরে দাবি উঠেছিল।
তবে এই দাবি প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। জাহানারা ইমাম ১৯৯১ সালে যুদ্ধাপরাধের শিরোমণি গোলাম আজমকে জামায়াতের আমির নির্বাচিত করার প্রতিবাদে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেন। সেই নির্মূল কমিটি থেকেই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল। কিন্তু সেই সময় এ দাবি বিএনপি বাস্তবায়ন করেনি। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারও বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে।
২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে এবং তার দাঁড়িপাল্লা প্রতীককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর থেকেই জামায়াত আসলে অনিবন্ধিত একটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের দলীয় কোনও প্রতীক নেই। কিন্তু তারপরেও জামায়াত সারা দেশে সংঘটিত হচ্ছে এবং নতুন ভাবে সন্ত্রাস এবং সহিংসতার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগেও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা একটি রিট আবেদন ছিল। সেই রিট আবেদনটি দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন অবস্থায় পড়ে আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে নাৎসি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত যে কোনও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করাটা সেই দেশের একটি আইনি প্রক্রিয়ার ব্যাপার এবং সব দেশ এটি করা হয়ে থাকে। এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে উগ্র বাম কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সেই বিবেচনায় স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি করাটাই একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। তবে এবার আওয়ামী লীগের ঘুম ভেঙেছে। অবশেষে আওয়ামী লীগ জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট ১৪ দলের সভায় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তের পরে প্রথম যে প্রশ্নটি এসেছে তা হলো এই সিদ্ধান্ত কীভাবে বাস্তবায়িত হবে।
আইনজ্ঞ এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, দু ভাবে এটি বাস্তবায়িত হতে পারে। প্রথমত এটি বাস্তবায়নের সহজ প্রক্রিয়া হলো সংসদে আইন পাশ করতে হবে এবং আইন অনুযায়ী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত হলো, যে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন আছে সেই মামলাটি নিষ্পত্তির মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। কারণ যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে জামায়াত-শিবিরকে সরাসরি যুদ্ধাপরাধে সম্পৃক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
এখন দেখার বিষয় সরকার কোন ভাবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। এটি সংসদে আইন পাশের মাধ্যমে করে নাকি আদালতের মাধ্যমে করে।
তবে যেভাবেই করা হোক না কেন শেষ পর্যন্ত ৭১’র নরঘাতকরা রাজনৈতিক অধিকার হারাচ্ছে, জনদাবি বাস্তবায়িত হচ্ছে,মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারিরা রাজনৈতিক অধিকার হারাচ্ছে এবং ইতিহাস তার পূর্ণতার বেলাভূমি স্পর্শ করছে এটাই আর একটি বিজয়।