সর্বশেষ সংবাদ
Home / প্রচ্ছদ / ঠাকুরগাঁওয়ে রানীশংকৈলে সীমান্তে ভারতের কাঁটা তারের বেড়ায় আবদ্ধ মন,এবার হোলোনা নববর্ষের মিলন মেলা 

ঠাকুরগাঁওয়ে রানীশংকৈলে সীমান্তে ভারতের কাঁটা তারের বেড়ায় আবদ্ধ মন,এবার হোলোনা নববর্ষের মিলন মেলা 

মোঃ মজিবর রহমান শেখঃ এতো কাছে পেয়েও ছুঁতে পারিনি তাকে। দীর্ঘ একটি বছর অপেক্ষা করে কাছে পেয়েও তাকে একটিবার ছুঁতে পারলামনা।

মনের ব্যাকুল আবেদন- তাকে কাছে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, বুকে টেনে ধরে দীর্ঘ দিনের মনের সাধটা একটু মিটিয়ে নিই। গত বছরও তাকে এভাবেই খুব কাছে পেয়েছি কিন্তু তা পারিনি। দু’জনই অপলক তাকিয়েছি একে অপরের দিকে। জোরে গলা ফাটিয়ে মনের সব আবেগ প্রকাশ করতে চেয়েও সবটাই পারিনি। কানে কানে যে কিছু কথা ছিলো তার সাথে, বলতে পারিনি।

সেও প্রাণপণ চেষ্টা করেছে আমাকে কাছে পাবার, একটু ছুঁয়ে আদর করার। তার মনের আকুতি- আমাকে একটিবার ছুঁয়ে মনের সব পিপাসা পূরণ করবে বলে। আরো কী যে বলার ছিলো তার-সেই জানে। যতক্ষণ কাছাকাছি ছিলো দু’জনেরই চোখ দিয়ে শুধু বয়ে চলেছে অশ্রুধারা।

অশ্রধারায় বুঝি কাঁটা তারের বেড়াটা নিমজ্জিত হয়। আর এ মাঝখানের কাঁটা তারের বেড়াটাই বুঝি বাধ সেঁধেছে। ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার চেকপোস্ট জগদল সীমান্তে এসে নাগর নদীর ধারে লাখো মানুষের ভীড়ে উপস্থিত ষাটোর্ধ বয়সী এক মহিলা।

তাঁকে সামনে দিয়ে পেছনে পেছনে হেঁটে ছুটছে মেয়ে, জামাই আর নাতি-নাতনি। গত বছরও এপথেই একই স্থানে ছুটে এসেছিলেন স্বজনকে একটিবার দেখার টানে। বর্তমানে স্বামীর ঘর সংসারের ঘানি টেনে জামাই বাড়িতে অবস্থান তাঁর। কিন্তু জীবনের শৈশব আর কৈশোর কেটেছে ওপার বাংলার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ এলাকায়। বাবার বাড়ী ছিল সেখানেই।

দেশ স্বাধীনের প্রায় এক যুগ পূর্বে সেতাবগঞ্জের জনৈক উপেন্দ্র রায়ের সাথে বিয়ে হয় তাঁর। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পালকিতে করে এই নাগর নদীর উপর দিয়েই তাঁকে এপার বাংলায় আনা হয় বউ সাজিয়ে। স্বামীর সংসারে মেয়ে শেফালী রানী ছাড়া আর কেউ নেই।

স্বামী এ জগত ছেড়েছেন ক’বছর হলো। জামাইয়ের অবস্থাও তেমন ভালো নেই। অনেক ইচ্ছে ছিলো একবার ওপার বাংলায় গিয়ে তাকে অন্ততঃ একটিবার ছুঁয়ে আসা। তাহলে মনে অনেক শান্তি পেতেন তিনি। মরে যাবার পরেও আর কোন আফসোস থাকতোনা তাঁর। কিন্তু জামাইয়ের অভাবের সংসারে তা আদৌ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই ঘুরে ফিরে এ দিনটির জন্য তাকে একটি বছর অপেক্ষায় দিন কাটতে হয়।

বাংলা নববর্ষের এদিনে যখন ভারত সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়ার দিক লক্ষ্য করে লাখো মানুষ নাগর নদী অতিক্রম করছে ঠিক সে সময়ে আমার সাথে দেখা হয় দিনাজপুর জেলার সেতাবগঞ্জ থেকে সড়ক পথে পাড়ি দিয়ে আসা সেই ষাটোর্ধ বয়সী বিমলা রানীর।

কৌতুহলভরে তাঁকে আটকে দিয়েই জানতে চাইলাম অনেক কিছু। কিন্তু এতো কিছু বলার সুযোগ কী তাঁর আছে? সবাই ছুটছে সে দিকেই, কাঁটা তারের বেড়াটাকে লক্ষ্য করে। সাথে আমিও। কাঁটা তারের বেড়ার ওপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তাঁর প্রাণের প্রিয় ছোট বোন প্রমিলা রানী। কখন তার সোনা মুখটি দেখবে এ বড় বোন।

মনে হয়, যেন অনেকদিন দেখেননি তাকে। কারণ, বাপের সংসারে এ ছোট বোনটি ছাড়া তাঁর আর যে কেউ নেই। এক বছর আগে এখানেই তাঁর সাথে দেখা হয় ছোট বোন প্রমিলা রানীর। তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন তাকে, তাঁর কাকাতো ভাই-বোনেরা কে, কেমন আছে? বাড়ীর উঠানে যে আম গাছটি তিনি লাগিয়েছিলেন সেটি কত বড় হয়েছে- ফল দেয় কীনা? সে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের ভিটায় যায় কীনা-ইত্যাদি।

উত্তরে প্রমিলা বলেছিলো, বাপের ভিটে-মাটি সে কবেই বিক্রি করে দিয়েছে তার বোন জামাই। সে কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। বড় বোনের এ অবস্থা দেখে কাঁটা তারের ওপারে ছটফট করছিল ছোট বোন প্রমিলা।

কিন্তু করার কিছুই নেই। তাঁকে যে ছোঁয়া মুশকিল! আট ফুটের এ কাঁটা তারের বেড়া তাদের সহস্র ইচ্ছাকে কবর দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে বিমলা ছোট বোন প্রমিলাকে জানালো-আমি ভালো আছি। তোমরাও ভালো থেকো। বেঁচে থাকলে আগামি বছর আবার এখানেই দেখা হবে আমাদের।

ভালো থেকো বোন। আর হ্যাঁ, তোমাদের জন্য তেমন কিছুই আনতে পারিনি। অনেকদিন ধরে ক’টা টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। তা দিয়েই তোমার পছন্দের সূতি শাড়ি, মতি-চূড়া লাড়ু আর কিছু গুড় মাখা ওখড়া নিয়ে এসেছি। জামাইকে ইশারা দিয়ে কাঁটা তারের বেড়ার উপর দিয়ে ওগুলো তাকে দিতে বললেন।

ছোট বোন প্রমিলা ঢুঁকরে ঢুঁকরে কেঁদে ওঠে। বড় বোন বিমলাও আর থেমে থাকতে পারলেন না। তাদের এ দৃশ্য দেখে অনেকেরই চোখে তখন জল। আর আমি…শুধু বিমলা-প্রমিলা নয়, প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এ মিলন মেলায়।

রক্ত আর স্বজনদের টানে সকল কাজ ফেলে দিয়ে অনেকেই ছুটে আসেন এখানে। বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার জগদল সীমান্তের চেকপোস্ট নামক স্থানের উত্তর-পশ্চিম আনুমানিক দেড় কিলোমিটার দূরে ভারতের কুকড়াদহ ক্যাম্পের অদূরেই বসে এ মিলন মেলা।

উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সম্মতিতে সীমান্ত খুলে দেয়া হয় কয়েক ঘন্টার জন্য। একটি বছর ধরে সীমান্তের এ কাঁটা তারের বেড়ায় সকলের মনটি পড়ে থাকে স্বজন দেখার নেশায়। ভারতের কাঁটা তারের বেড়ার উভয় পাশে দুই বাংলার স্বজনরা জড়ো হয়ে ওই সময়টুকুতে নিজেদের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ, পাওয়া-না পাওয়ার সব কিছুই ভাগাভাগি করে নেন নিজেদের মধ্যে।

About admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

x

Check Also

চিলমারীতে কলেজ ছাত্র হত্যা: আসামী গ্রেফতারে ১২ ঘন্টার আল্টিমেটাম 

  কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: কুড়িগ্রামের চিলমারীতে কলেজছাত্র জোবায়ের আমিন হত্যা মামলায় গেলো ১৩ ...