সদরুল আইনঃ
গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে কোনোভাবেই অস্থিরতা থামছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গাজীপুর ও সাভারের ৩১টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে ১১৪টি কারখানা গতকাল বুধবার বন্ধ ছিল। আন্দোলনকারী শ্রমিকরা গাজীপুরের বিগ-বসের কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন ধরিয়ে দেয়। অগ্নিকাণ্ডে কারখানার কেমিক্যাল গোডাউন সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।
টানা প্রায় দুই সপ্তাহের অস্থিরতার কারণে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অর্ডার অন্য দেশে চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। শনিবারের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা তার।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে শ্রমিকদের শান্ত থাকতে বলেছেন। এদিকে বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বুধবার ১১৪টি কারখানা বন্ধ ছিল। বিজিএমইএর সদস্য কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১৪৪টি।
বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে ১১১টি সাভার, আশুলিয়া ও জিরানী এলাকায়। আর গাজীপুরে তিনটি কারখানা বন্ধ আছে। ১ হাজার ৩০৯টি কারখানা ইতিমধ্যে আগস্ট মাসের বেতন দিয়েছে। ৮৩৫টি কারখানা এখনো আগস্ট মাসের বেতন দিতে পারেনি।
বিজিএমইএর তথ্য বলছে, শ্রমিক অসন্তোষ হচ্ছে মূলত গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও জিরানী এলাকায়।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আরএমজি এবং নন-আরএমজি সেক্টরের শ্রম অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনাপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় আয়োজন করা হয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সভাপতিত্বে সভায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, একটি বড় প্রতিষ্ঠানের গতকাল বেতন দেওয়ার কথা ছিল। বেতন দিতে না পারায় দুপুর থেকে ঐ কারখানার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। গার্মেন্টস খাত সিজনাল ব্যবসা, আজ ঠিক করা হয় তিন মাস পর কোন পণ্যটা বাজারে আসবে।
তাই এই একটা সিজনে সমস্যার কারণে বায়াররা অন্য স্থান থেকে সোর্সিং করছে। এতে করে আমাদের প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অর্ডার অন্য দেশে চলে গেছে।
গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভের কারণে অন্তত ৩০টি কারখানায় ছুটি এবং ছয়টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শ্রমিকদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষে আহত হয়েছে আট শ্রমিক। এছাড়া আন্দোলনে অংশ না নেওয়ায় কাশিমপুরের বিগ-বস পোশাক কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শ্রমিক ও শিল্প পুলিশ সূত্র জানায়, গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুরের সারাব এলাকায় অবস্থিত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে কর্মরত শ্রমিকরা আগস্ট মাসের বেতনের দাবিতে দুই দিন ধরে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৪৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ গত মঙ্গলবার বেতন পরিশোধের ঘোষণা দেয়। ঐ দিন মাত্র ৮ ভাগ শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয়।
এতে বেতনবঞ্চিত বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত নবীনগর-চন্দ্রা সড়ক অবরোধ করে রাখে। একই দাবিতে গতকাল সকালে শ্রমিকরা কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ করে।
আন্দোলনরতরা সারাব এলাকার বিগ-বস ফ্যাশনসহ আশপাশের কারখানার শ্রমিকদের তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। বিগ-বসের শ্রমিকরা আন্দোলনে যোগ না দিয়ে তাদের ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে সকাল সাড়ে ১২টার দিকে আন্দোলনকারী শ্রমিকরা বিগ-বসের কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন ধরিয়ে দেয়।
ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গেলেও বিক্ষোভকারীদের বাধার মুখে আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়। পরে স্থানীয়দের সহাওতায় বিকাল ৪টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। অগ্নিকাণ্ডে কারখানার কেমিক্যাল গোডাউন সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। বিকাল ৬টা পর্যন্ত ঐ এলাকায় সড়ক অবরোধ করে রাখে শ্রমিকরা।
বিগ-বস কারখানার কর্মকর্তা ওয়াহেদ খান বলেন, বেক্সিমকোর শ্রমিকরা আমাদের কারখানার ওয়্যার হাউজে অগ্নিসংযোগ করে। সেখানে মূল্যবান ফেব্রিক্স ছিল। কাশিমপুর থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম বলেন, বেক্সিমকো গ্রুপের কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করে। এ সময় তারা অন্যান্য কারখানাও বন্ধ করতে বিভিন্ন কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চালায়। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ চেষ্টা করছে।
অপরদিকে সকালে মহানগরীর তিন সড়ক এলাকায় সর্বনিম্ন বেতন ১৮ হাজার টাকা, ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ, ক্যাজুয়াল কর্মীদের মাতৃত্ব ভাতা ও ছুটি প্রদান, অ্যাডমিনের পদত্যাগ, বাৎসরিক ছুটি প্রদানসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করে আড়ং ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রজেক্টের কর্মীরা।
কারখানা কর্তৃপক্ষ সাড়া না দেওয়ায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শ্রমিকরা। একই সময়ে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে নগরীর বাংলাবাজার এলাকার পারটেক্স গ্রুপের পারটেক্স বেভারেজ কারখানাতেও শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। সদর উপজেলার বাঘেরবাজার এলাকায় কনফিডেন্স গার্মেন্টস ও গ্রীন ফাইবার কারখানার শ্রমিকরা একই দাবিতে কর্মবিরতি পালন করে বিক্ষোভ করে।
দুপুরে ফুয়াং সিরামিকের শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে কারখানার সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে। পাঁচ মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বুধবারও পোড়াবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে ভার্গো কারখানার শ্রমিকরা।
টঙ্গীতে সকাল ৮টা থেকে তিস্তারগেট এলাকার হক অ্যান্ড কোম্পানির সহস্রাধিক শ্রমিক সিইও আফতাব উদ্দিনের পদত্যাগ, বেতন বৃদ্ধি, বৈষম্য দূরীকরণসহ ১০ দফা দাবিতে উৎপাদন কাজ বন্ধ করে কারখানার সামনে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
পরে ঐ শ্রমিকরা পার্শ্ববর্তী মেঘনা রোডে গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেইজ লিমিটেড, ব্রাভো অ্যাপারেলস লিমিটেড ও পিনাকী গার্মেন্টসের সামনে জড়ো হয়ে কারখানা শ্রমিকদের নিচে নামতে হইহুল্লোর করে কারখানার গেটে ও জানালায় ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। এ সময় শ্রমিকদের তোপের মুখে গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেইজ লিমিটেড, ব্রাভো অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানা দুটি এক দিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করলে শ্রমিকরা কারখানা ত্যাগ করে।
শ্রমিক আন্দোলনের কারণে বুধবার গাজীপুর ও সাভারের ৩১টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে সাভারে ২৫টি ও গাজীপুরে ৬ টি কারখানা রয়েছে।শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, বুধবার সাভারে আটটি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।